আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য কেনা হচ্ছে ৬০ গাড়ি

ঢাকাঃ আহমেদ রাব্বী (রিপোর্টার)
ছবি সংগৃহীত ছবি:
ছবি সংগৃহীত ছবি:

ঢাকা থেকে:
বাংলাদেশে আসন্ন সরকারের মন্ত্রিপরিষদের জন্য ৬০টি নতুন গাড়ি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর। বাজেট, অর্থনৈতিক সংকট এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তির প্রেক্ষাপটে এই গাড়ি কেনার খবর সমাজে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

কেন গাড়ি কেনা হচ্ছে?

সরকারি সূত্র বলছে, আসন্ন মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়া নতুন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের জন্য গাড়ি প্রয়োজন হবে। সাধারণত প্রতিটি সরকারের মেয়াদে নির্দিষ্ট সংখ্যক গাড়ি কেনা হয়, কারণ পুরনো গাড়িগুলো অনেক সময় অচল বা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এবারও সেই ধারাবাহিকতায় নতুন করে গাড়ি কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

একজন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—
“মন্ত্রীদের কাজের সুবিধার্থে অফিসিয়াল গাড়ি দেওয়া হয়। এটা সরকারের নিয়মিত প্রক্রিয়ার অংশ। নতুন সরকার গঠনের আগেই এসব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা জরুরি।”

গাড়ির ধরণ ও সম্ভাব্য মূল্য

অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, এবার কেনা হচ্ছে জাপানি ও কোরিয়ান ব্র্যান্ডের আধুনিক মডেলের বিলাসবহুল সেডান ও এসইউভি। প্রতিটি গাড়ির দাম ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে। অর্থাৎ, মোট বাজেট দাঁড়াতে পারে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

তবে এই গাড়িগুলো আমদানি করা হবে নাকি দেশীয় বাজার থেকেই কেনা হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। প্রাথমিকভাবে দুটি বিকল্প নিয়ে কাজ করছে সরকার।

সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া

দেশে যখন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য নিয়ে মানুষ দিশেহারা, তখন সরকারি টাকায় মন্ত্রীদের জন্য ৬০টি গাড়ি কেনার খবর নাগরিক সমাজে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।

রাজধানীর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জানায়—
“আমরা বাসে ঝুলে ঝুলে চলাচল করি, ট্রাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকি। সেখানে নতুন সরকার আসার আগেই ৬০টা গাড়ি কেনার খবর শুনে মনে হয়, আমাদের টাকাই শুধু বিলাসে খরচ হচ্ছে।”

একজন শ্রমিকের বক্তব্য আরও কড়া—
“আমাদের ঘরে ভাত নাই, বাজারে আগুন; অথচ সরকার মন্ত্রীদের জন্য কোটি কোটি টাকার গাড়ি কিনবে! এটা জনগণের সঙ্গে অন্যায়।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সময়টা এমন, যখন দেশের অর্থনীতি চাপে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে, তখন এত বড় অঙ্কের টাকা গাড়িতে খরচের সিদ্ধান্ত জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন—
“সরকারি গাড়ি অবশ্যই প্রয়োজনীয়, তবে অতি বিলাসী মডেল কেনার প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানের অফিসিয়াল গাড়ি দিলেই যথেষ্ট। জনগণের কষ্টের সময় সরকারকে মিতব্যয়ী হতে হবে, নইলে নেতাদের প্রতি আস্থা কমে যাবে।”

পূর্বের অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের শুরুতে মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনার ইতিহাস রয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর একসাথে ৫০টির বেশি গাড়ি কেনা হয়েছিল। আবার ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরও মন্ত্রীদের জন্য নতুন গাড়ি কেনা হয়।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে গাড়ি কেনার বাজেট এত বিপুল ছিল না। এখন গাড়ির দাম ও কর বৃদ্ধি পাওয়ায় একসাথে ৬০টি গাড়ি কেনা অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে।

সরকারি ব্যাখ্যা

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, জনগণের টাকাই জনগণের সেবায় খরচ হবে। মন্ত্রীরা সারাদেশে বিভিন্ন কাজের জন্য ভ্রমণ করেন। সরকারি কাজে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের জন্য তাদের উপযুক্ত যানবাহন থাকা জরুরি।

একজন সচিব বলেন—
“মন্ত্রীদের চলাফেরা শুধু ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রের মর্যাদার বিষয়ও আছে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে আধুনিক গাড়ির প্রয়োজন।”

বিরোধী দলের সমালোচনা

অন্যদিকে বিরোধী দল ও সমালোচকরা বলছেন, এটি সরকারের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা অভিযোগ করছেন, জনগণের রক্ত-ঘামে অর্জিত করের টাকা অপচয় করা হচ্ছে।

বিএনপির একজন নেতা মন্তব্য করেন—
“দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে, শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে শিক্ষা পাচ্ছে না। অথচ ক্ষমতাসীনরা নিজেদের বিলাসের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। এটা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।”

নাগরিক সমাজের প্রশ্ন

প্রশ্ন উঠেছে— কেন পুরনো গাড়িগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে না? অনেক সরকারি দপ্তরে শত শত গাড়ি অচল হয়ে পড়ে আছে, যা সংস্কার করে ব্যবহার করা যেত। এতে বিপুল অঙ্কের টাকা সাশ্রয় হতো।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর এক প্রতিনিধি বলেন—
“আমাদের দেশে যেকোনো সিদ্ধান্তই যেন হয় বিলাসিতা প্রদর্শনের জন্য। অথচ বিদেশের অনেক উন্নত দেশেও সরকারী কর্মকর্তারা মাঝারি মানের গাড়ি ব্যবহার করেন। সেখানে আমাদের মন্ত্রীরা কেবল বিলাসবহুল গাড়িই চান।”

করদাতাদের টাকায় বিলাসিতা

বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিটি মন্ত্রীর জন্য গাড়ি, চালক, জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ— সবই করদাতাদের টাকায় চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।

প্রতি বছর গাড়ির জন্য শুধু জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কয়েকশ কোটি টাকা খরচ হয়। নতুন ৬০টি গাড়ি যুক্ত হলে এ ব্যয় আরও বাড়বে।

আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য ৬০টি নতুন গাড়ি কেনার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একদিকে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন এটি প্রয়োজনীয়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ও সমালোচকরা বলছেন এটি জনগণের টাকার অপচয়।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যখন অর্থনীতি সংকটে, তখন মন্ত্রীদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনা কতটা যৌক্তিক— এ প্রশ্ন আজ জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের উচিত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, যাতে জনগণ বিশ্বাস করতে পারে যে প্রতিটি টাকাই তাদের কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে। অন্যথায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত জনগণ ও সরকারের মধ্যে আস্থার সেতু আরও দুর্বল করে দেবে।

বিষয়:

Govt. Car Budget
এলাকার খবর

সম্পর্কিত