আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে রহস্য ও বিতর্ক

ফোরকান জামান,শার্শা(যশোর):
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে রহস্য ও বিতর্ক ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে রহস্য ও বিতর্ক ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলেম, জনপ্রিয় তাফসীরকার এবং জামায়াতে ইসলামী নেতৃবৃন্দের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট, সোমবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি কারাবন্দি জীবন কাটান।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত এই আলেমের মৃত্যু নিয়ে এখনও অনেকের মনে সন্দেহ বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সাধারণ সমর্থকদের মধ্যেও রয়েছে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক। অনেকে মনে করেন, তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন এবং পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। সমালোচকদের অভিযোগ, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তিনি কারাগারে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হন।তাদের দাবি, মৃত্যুর আগে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তুলনামূলকভাবে সুস্থ ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করেই তার মৃত্যু ঘটে, যা স্বাভাবিক মনে হয় না। যদিও সরকারিভাবে বলা হয়, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তবে অনেক শুভানুধ্যায়ী এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ এবং এটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এই আলেম জীবদ্দশায় নসিয়ত করেছিলেন যে, খুলনার বসুপাড়ায় নিজ হাতে গড়া দারুল কুরআন সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা প্রাঙ্গণে তার জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হবে। এজন্য তিনি মসজিদের পাশে নিজের ও স্ত্রীর জন্য দুটি কবরের স্থান কিনেও রেখেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সশস্ত্র বিরোধিতার কারণে সেখানে দাফন সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পিরোজপুরের নিজ গ্রামে দাফন করা হয়। এ কারণে ১৪ আগস্ট এলেই খুলনার সাঈদীভক্তদের মনে গভীর বেদনার সঞ্চার হয়।

১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী উপজেলার সাঈদখালী গ্রামে জন্ম নেন আল্লামা সাঈদী। পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী ছিলেন প্রখ্যাত আলেম, আর মাতা গুলনাহার বেগম ছিলেন গৃহিণী। প্রাথমিক শিক্ষা বাবার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় শেষ করে তিনি ছারছিনা ও খুলনা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৬৪ সালে কামিল ডিগ্রি অর্জনের পর ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানে গভীর অনুরাগ গড়ে তোলেন।

১৯৬৭ সাল থেকে ইসলামের দাওয়াতি কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন। দেশ-বিদেশের শতাধিক তাফসীর মাহফিলে অংশ নিয়ে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। জীবদ্দশায় তিনি ৭৭টি গ্রন্থ রচনা করেন এবং অর্ধ শতাধিক দেশে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেন। তাঁর কোরআন তাফসীর ও ধর্মীয় বক্তৃতা লাখো মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে।

১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর সাথে যুক্ত হন আল্লামা সাঈদী। ধাপে ধাপে তিনি রুকন, মজলিশে শুরা সদস্য এবং নির্বাহী পরিষদের পদে আসীন হন। ২০০৯ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি দলের নায়েবে আমীর ছিলেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পিরোজপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে ধর্ম মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে ২০১৪ সালে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আজীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করে। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কারাগারেই ছিলেন।

২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন পিরোজপুরে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। দাফনের সময় বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেন এবং অনেকেই তাঁকে “শহীদ” বলে অভিহিত করেন।

এলাকার খবর

সম্পর্কিত